নাজিম আহমেদ, রৌমারী (কুড়িগ্রাম):
কুড়িগ্রাামের রৌমারী উপজেলার সোনাভরি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলী দুর্নীতির মহানায়ক। তার বিরুদ্ধে লুটপাট, দুর্নীতি, শিক্ষকদের টিউশন ফি’র টাকা আত্মসাৎ, জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, এনআইডি কার্ড জালিয়েতি, বয়স গোপন করে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষাখাতে এমন কোনো স্তর নাই যেখানে তার কালো থাবা পড়েনি। দুর্নীতির কালো টাকায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সামান্য একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়ে বিভিন্ন শহরে গড়েছেন বহুতল ভবন, কিনেছেন মূল্যবান জায়গাও। চাকরি দেওয়ার বদলে আপন ভাই, ভাজিতার কাছ থেকে লিখে নিয়েছেন জমি। নিজের চাকরির সুবাদে তার পরিবারের আরও ৫জন চাকরি দিয়েছেন সোনাভরি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ওই প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলী। সরেজমিন অনুসন্ধানে স্কুলের শিক্ষক-অভিভাবক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিভাগীয় শহর রংপুরের প্রাইম মেডিক্যাল এলাকায়, মর্ডান মোড়ে, কুড়িগ্রাম সদরের তালতলায়, রৌমারী সিজি জামান স্কুলের পশ্চিশ পাশে, রৌমারী বাজারের থানা রোডে ভবনসহ দোকান ঘর, খঞ্জনমার গণিমোল্লাহ মাদ্রাসা সংলগ্ন, দক্ষিণ খঞ্জনমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে, রৌমারী সরকারি কলেজ সংলগ্ন জমি ও বড়ো দুই ভাই রায়হান, আনোয়ার, ভাতিজা মেহেদীকে চাকরি দেওয়ার বদলে প্রায় বিঘা খানিক জমিসহ মোট জমির পরিমাণ প্রায় ১৩০ শতাংশ। যার আনুমানি বাজর মূল্য ৬/৭ কোটি টাকা। পুরোটাই দুর্নীতি, অনিয়ম ও নানা জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) তথ্যানুযায়ী, ২০০২ খ্রি. প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। ২৩/১০/২০১৯ খ্রি. নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক দুটি শাখা-ই এমপিওভুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৮ জন। নারী শিক্ষক ২জন ও ১২জন পুরুষ শিক্ষক, ৩জন পুরুষ ও ৩জন নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী মোট ৬জন। ১৮ জনের মধ্যে ৬জনই একই পরিবারের। প্রধান শিক্ষক শাহজাহানের স্ত্রী আরজিনা আক্তার, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে, তার এক বড়ো ভাই আনোয়ার হোসেন নিরাপত্তা কর্মী পদে, আরেক বড়ো ভাই রায়হান আলী পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে, বড়ো ভাই আ: বাতেনের মেয়ে কামরুল লায়লা অফিস সহায়ক পদে, বড়ো ভাই আকতারের ছেলে মেহেদী হাসান নৈশ প্রহরী পদে কর্মরত আছেন। মেহেদী হাসান এসএসসি পাশ করেন ২০২২ খ্রি. কিন্তু উক্ত পদে নিয়োগের বেলায় তার বয়স কম থাকার কারণে জন্মনিবন্ধনে বয়স বাড়িয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
সোনাভরি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এপিওভুক্ত হওয়া যেনো প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলীর কাছে ছিল টেক্কার কার্ড। ২০১৯ খ্রি. এমপিওভুক্ত হওয়ার একমাসের মধ্যে ৪জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন পূর্বের নিয়োগ তারিখ দেখিয়ে। ৪ শিক্ষকের প্রতিজনের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে প্রায় ১৬/১৭ লক্ষ টাকা। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ নতুন নিয়ম চালু করে সরকার। সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে আনোয়ার হোসেন, সহকারী শিক্ষক পদে রেজাউল করিম (বিজ্ঞান), হাশেম আলী (বাংলা), জাকির হোসেন (গণিত) ও সাইফুল ইসলামকে (ইংরেজি) মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম দেখানো হয়েছে ৬ বছর আগের তারিখ ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর ও ২৮ ডিসেম্বর। নিয়োগ কমিটিতে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) প্রতিনিধি হিসেবে অনুমোদন দেয়া ছিল উলিপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রীতা রানীকে। নিয়োগ পরীক্ষার স্থান দেখানো হয় উলিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ প্রসঙ্গে উলিপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) রীতা রানী বলেন, ‘আমি রৌমারীর সোনাভরি আদর্শ বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নেই নি।’
অন্য শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও নিজের পরিবারের লোকজনকে নিয়োগের অভিযোগ ভয়াবহ। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলীর বাবা বাহাদুর আলী ছিলেন নানা পেশার মানুষ। কখনো কখনো গ্রামের টিউশনি কখনো কখনো নিজের সামান্য জমিতে চাষবাদ করে জীবন নির্বাহ করতেন। বাহাদুর আলীর ছেলে সন্তান পাঁচজন। জন্মগত ভাবে প্রথম সন্তান আব্দুল বাতেন, দ্বিতীয় সন্তান আকতার হোসেন, ভোটার আইডি অনুসারে তার জন্ম তারিখ ২/১২/১৯৬৯ খ্রি., তৃতীয় সন্তান আনোয়ার হোসেন, ভোটার আইডি অনুসারে তার জন্ম তারিখ ১০/০৫/১৯৭২ খ্রি., চতুর্থ সন্তান রায়হান আলী, ভোটার আইডি অনুসারে তার জন্ম তারিখ ১৬/০৫/১৯৭৪ খ্রি. ও পঞ্চম সন্তান শাহজাহান আলী, ভোটার আইডি অনুসারে তার জন্ম তারিখ ০৬/০৮/১৯৭৮ খ্রি.।
ব্যানবেইসের শিক্ষক-কর্মচারীর তথ্য অনুযায়ী-বাহাদুর আলীর তৃতীয় সন্তান ও অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলীর বড়ো ভাই আনোয়ার হোসেনের জন্ম তারিখ ১৫/০১/১৯৮৬খ্রি.। ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করে বয়স কমনো হয়েছে ১৩ বছর ৩ মাস ১০ দিন। একইভাবে বাহাদুর আলীর চতুর্থ সন্তান ও অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলীর বড়ো ভাই রায়হান আলীর জন্ম তারিখ ১৬/০৫/১৯৮৫খ্রি.। ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করে বয়স কমনো হয়েছে ১১ বছর। আনোয়ার ও রায়হানের জন্ম ব্যবধান মাত্র ৮ মাস।
দুই ভাইয়ের বয়স কমানো ব্যাপারে উপজেলা নির্বাচন অফিসার লিটু আহমেদ বলেন, এনআইডি জালিাতে অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি আইডি সংশোধন বাতিল করে পূর্বের অবস্থায় ফেরত পাঠোনো হয়। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলীর জন্মগত বড়ো ভাই ভোটার আইডি সংশোধন করে কীভাবে ছোট হয়? বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
ওই বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন স্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলীর দুই বড়ো ভাই ওই স্কুলেই চাকরি করেন। টিউশন ফির ব্যাপারে সহকারী প্রধান শিক্ষক কিছুই জানেন না। স্কুলের কোনো ফান্ড আছে কী না ও পুরাতন ঘর বিক্রয়ের অর্থ কোথায় আছে না খরচ হয়ে গেছে তাও জানেন না।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলী বলেন- নিয়োগ দেওয়া আমার কাজ না। যারা নিয়োগ দিয়েছেন তাদের কাছে খোঁজ নেন বলেই মোবাইল ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুর রউফ বলেন- এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেন নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার উজ্জ্বল কুমার হালদার বলেন- এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাই নি। অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply